প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা ছিল অন্তঃসারশূন্য ও হৃদয়হীন। সেই শিক্ষায় ছিল না শিশুর স্থান, শিক্ষাব্যবস্থা ছিল শিক্ষক প্রধান। কিন্তু আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন দিক থেকে অনেক পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে সমাজ বিজ্ঞানের প্রভাবের ফলে শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যেও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আলােকপাত ঘটেছে। এই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি শিশুমনের অতল তলে ডুব দিয়ে তাদের মনরাজ্যের গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটনে কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছে এবং কার্যত শিক্ষাপদ্ধতি মনােবিজ্ঞানসম্মত রূপ পেয়েছে।
এই সমস্ত পদ্ধতির প্রবর্তক হিসেবে বিংশ শতাব্দীর শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার ইতিহাসে অনেকের দান চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। এঁদের মধ্যে ম্যাডাম মন্টেসরির নাম চিরস্মরণীয় ও সর্বজনবিদিত।
মন্টেসরি পদ্ধতির প্রেক্ষিত : মন্টেসরি গণতান্ত্রিক চেতনার দ্বারা চেতনায়িত ও প্রভাবিত হয়ে বিকলাঙ্গ ও জড়বুদ্ধিদের জন্য ভেবেচিন্তে শিক্ষার মধ্যেই তাদের স্বাভাবিক জীবন বিকাশের উপায় অনুসন্ধান করেছেন। এই কাজে তাকে বিশেষ উৎসাহিত ও সহায়তা করেছে ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত E. Seguin এর ‘ldiocy — its treatment by Physiological Method’ বইটি এবং লােরেন ব্রিজম্যান (Lorain Bridgeman) ও হেলেন কেলারের (Hellen Keller) সার্থক সাফল্য।
এজন্য তিনি শিক্ষার উদ্দেশ্য হিসেবে আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরতা সৃষ্টি করে পারিবারিক দক্ষতার বিকাশ ও জ্ঞানেন্দ্রিয়সমূহের অনুশীলনকে বিশেষ মূল্য দিয়েছেন। এর ফলে তিনি শিশুদের অঙ্গ সঞ্চালন, পেশীর অনুশীলন, পড়া, লেখা ও গণিতের জ্ঞান ও দক্ষতার্জন, হাতের কাজ, উদ্যানের কাজ, আঁকা, গান গাওয়া এবং প্রকৃতি পরিচয়ের মধ্য দিয়ে সৌন্দর্যবােধ ও সংস্কৃতির উৎকর্ষণ প্রভৃতিকে শিক্ষার উদ্দেশ্য মনে করেছেন।
এই উদ্দেশ্যসমূহের ওপর ভিত্তি করে স্পর্শ ইন্দ্রিয়ের প্রতি প্রাধান্য দিয়ে যে শিক্ষাপদ্ধতি তিনি উপস্থাপন করেন তাকে অনেকে Touch Method বলেছেন।
মন্টেসরি পদ্ধতির রূপরেখা : ইতালির ম্যাডাম মেরিয়া মন্টেসরিই (Maria Montessori) ‘মন্টেসরি পদ্ধতির’ প্রবর্তক। তিনি শিশুশিক্ষার জনক রুশাের শিক্ষাচিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি শিশুর সক্রিয় স্বাধীনতার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
ফ্রয়বেলের মত তিনিও ইন্দ্রিয় পরিচালনার প্রশিক্ষণের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। একজন চিকিৎসাবিদ হিসেবে তার কর্মজীন শুরু কিন্তু পরবর্তীকালে স্বল্পবুদ্ধি, বিকলাঙ্গ শিশুদের শিক্ষামূলক গবেষণায় নিজেকে পরিপূর্ণভাবে নিয়োজিত করেন।
তার শিক্ষাতত্ত্বকে প্রয়ােগ করার জন্য তিনি ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এর নাম দেন ‘Casa-dei-Bambini’ বা ‘শিশু নিকেতন’। শিশুর মধ্যে যে অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা আছে তাকে মূর্ত করে তােলাই হল এই পদ্ধতির মূল কথা।
তিনিও ফ্রয়বেলের উপহার ও বৃত্তির (Gifts and occupations) মত নানা ধরনের খেলনা তৈরি করেন ও এদের নাম দেন ‘ডিডাকটিক যন্ত্র’ (Didactic apparatus)।
খেলনাগুলাে এমনভাবে পরিকল্পিত যে শিশুরা নিজেরাই এসব খেলার মাধ্যমে নিজেদের ইন্দ্রিয়ের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিতে সমর্থ হয় ও নিজেদের ভুল ত্রুটিরও সংশােধন করতে পারে।
আর এভাবে মন্টেসরি অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উপকরণ ব্যবহারের দ্বারা সংশােধনের যে শিক্ষার কথা বলেছেন তাইই আত্মশিক্ষার প্রকৃত মূল হিসেবে বিবেচিত।
তার বিদ্যালয়ের শিক্ষাকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে থাকে স্বাবলম্বন শিক্ষার ব্যবস্থা; দ্বিতীয় পর্যায়ে থাকে ইন্দ্রিয়ের শক্তি বৃদ্ধির বহুবিধ অনুশীলন এবং তৃতীয় পর্যায়ে থাকে শিক্ষামূলক অনুশীলন। এক্ষেত্রে মন্টেসরি সেগুঈন পদ্ধতিকে অনুসরণ করেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই যে মন্টেসরি পদ্ধতিতে পড়ার শিক্ষা লেখা শিক্ষার পারে দেওয়া হয়।
মন্টেসরি শিক্ষা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য : মন্টেসরিয় শিখন পদ্ধতির প্রথম ও শেষ কথা হল শিশুদের অবাধ স্বাধীনতা। তার মতে সক্রিয়তাই হচ্ছে স্বাধীনতা। তবে যদিও তিনি অবাধ স্বাধীনতার কথা বলেছেন, তবু অবাধ বলতে যা খুশি তাই-ই করাকে বােঝাননি।
তিনি বলেছেন বিদ্যালয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার মধ্যে দিয়েই শিক্ষার্থীরা শিখবে নিজেদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে। এইভাবে যে শৃঙ্খলা গড়ে উঠবে তাকেই তিনি প্রকৃত শৃঙ্খলা বলেছেন। এজন্য মন্টেসরি পদ্ধতিতে পৃথকভাবে নীতি শিক্ষার স্থান দেওয়া হয়নি। তার মতে স্বাভাবিক সামর্থ্য, ক্ষমতা ও আগ্রহের বিকাশই নীতিবােধ শিখতে সহায়তা করে।
দ্বিতীয়ত, মন্টেসরি পদ্ধতিতে শিক্ষার ভিত্তি গড়ে উঠবে তার সক্রিয় প্রচেষ্টার দ্বারা। মূলত কাজের মধ্যে দিয়েই শিশু তার জীবন গড়ে তুলবে। বিভিন্ন ইন্দ্রিয় পরিমার্জনের উপযােগী কাজ দেওয়ার জন্য মন্টেসরি ডিডাকটিক যন্ত্রের প্রবর্তন করেন। মন্তেসরী পদ্ধতিতে শিক্ষিকার নাম দেওয়া হয়েছে পরিচালিকা (Directress)। অর্থাৎ এই শিক্ষায় বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় স্বয়ংশিক্ষার নীতি (Principle of auto education)। এখানে শিশুরাই সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে।
তৃতীয়ত, তিনি ইন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয় উভয়ের কথাই বিশেষভাবে বলেছেন। তিনি বাগানের কাজ করা ও পশুপাখি পোষার কথাও উল্লেখ করেছেন। এতে তার মতে কর্মেন্দ্রিয়ের যেমন বিকাশ সম্ভব, তেমনি সম্ভব সামাজিক বিকাশ।
চতুর্থত, মন্টেসরি পদ্ধতির আর একটি বৈশিষ্ট্য হল এর ব্যক্তিপার্থক্যের তত্ত্ব, শিক্ষণ পদ্ধতির ব্যক্তীকরণ এবং বিদ্যালয়ের সময় নির্ঘণ্টের স্থানে শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও মনঃসংযােগের মাপকাঠিতে নির্ঘণ্ট তৈরির ব্যবস্থাপনা।
জন্ এ্যাডামস উপরােক্ত বিষয়সমূহ বিবেচনা করেই অভিমত দিয়েছেন এবং বলেছেন যে মন্টেসরি শ্রেণিপাঠ ব্যবস্থার মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়েছেন (Tolled the death knell of class teaching)। তিনি বলেছেন প্রতিটি শিশুরই নিজস্ব ব্যক্তিসত্তা বিদ্যমান। সেই থেকে তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে।
মন্তব্য : উপরােক্ত প্রেক্ষিতে শেষে মন্তব্য করে বলা যায় যে, শিক্ষণ পদ্ধতি এমন হওয়া উচিত যেন সেখানে ব্যক্তিপার্থক্যের বৈশিষ্ট্য ক্ষুন্ন না হয় এবং শিক্ষার্থীর স্বাধীনতা ও সক্রিয়তা বজায় থাকে। এই মন্টেসরি পদ্ধতিতে ব্যক্তিপার্থক্য ও শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা ও সক্রিয়তাকে ভিত্তি করে যে বিজ্ঞানসম্মত মনােবৈজ্ঞানিক প্রকাশ ধরা পড়েছে তা অবশ্যই এই পদ্ধতিটির শিশুকেন্দ্রিক মূল্যমান বাড়িয়েছে অনেকখানি।