পাঠ পরিকল্পনার (Lesson Plan) জন্ম হয়েছে গেস্টাল্ট মনস্তত্ত্ব থেকে। মানুষের শিখনের ক্ষেত্রে গেস্টাল্ট তত্ত্ব বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। শিখনের ক্ষেত্রে একক পাঠের বিশেষ ভূমিকা আছে।
শিক্ষাদান কৌশল একটি বিজ্ঞান। এর সঙ্গে শিল্পকলারও যােগ আছে। বৈজ্ঞানিক শিক্ষা পদ্ধতির মূল সূত্রটি হল যে শিক্ষার্থীরা নিজেদের চেষ্টায় অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে শিক্ষালাভ করবে। প্রত্যেকটি বিষয়ের কার্যকারণ সম্পর্কটি আবিষ্কার করবে। শিক্ষক প্রকৃত ভগীরথের মতাে তাদের পথনির্দেশ করবেন। কীভাবে শ্রেণি পাঠনার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের সাহায্য করবেন — সেই সম্পর্কিত বিষয়ের বর্ণনাটি হল পাঠ পরিকল্পনা (Lesson Plan)। শিক্ষক এমনভাবে পাঠ পরিকল্পনা করবেন শিক্ষার্থীরা যেন সর্বদাই একজন আবিষ্কারের ভূমিকায় থাকে।
Table of Contents
পাঠ (Lesson) কাকে বলে
একটি শ্রেণিতে একটি নির্দিষ্ট সময় সীমা বা পিরিয়ডে শিক্ষক পাঠক্রমের যে অংশটুকু শিক্ষার্থীদের নিকট আলােচনা করেন এবং যাতে অংশগ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা বিষয়টুকু সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে বা আয়ত্ত করতে পারে, তাকে পাঠ (Lesson) বলা হয়।
সুপ্রসিদ্ধ জার্মান শিক্ষাবিদ জোহান হাবার্ট, জন ডিউই এবং কিলপ্যাট্রিক পাঠদানের ক্ষেত্রে Unit Plan বা একক পরিকল্পনার উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। তারা শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করেছেন।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ B.F. Skinner একক পরিকল্পনার একটি আধুনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, শিক্ষার্থীর শিক্ষাগ্রহণ যথেষ্ট ফলপ্রসু হবে যদি তা ছােটো ছােটো এককে পরিবেশিত হয় এর উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে পাঠ পরিকল্পনার (Lesson Plan) পদ্ধতি।
পাঠটীকা (Lesson Plan) কাকে বলে
প্রতিদিন বিদ্যালয়ে শিক্ষক পাঠদানের জন্য পাঠ লিখিত করে আনেন। যে লিখিত কৌশলের ওপর নির্ভর করে শিক্ষক পাঠদান করেন তাকে বলা হয় পাঠটীকা (Lesson Plan)। Monroe, Bossing এবং Shipley প্রমুখ শিক্ষাবিদ পাঠটীকার সংজ্ঞা দিয়েছেন। Monroe- এর মতে, “Lesson Plan is the name of a statement of the things a teacher proposes to do during the period he spends with his class.”। কিন্তু N.L.Bossing- এর মতে, শ্রেণিকক্ষের শিক্ষা পরিকল্পনায় শিশুকেই কেন্দ্রে রাখা উচিত। শিক্ষণ হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে শিক্ষার্থীর ওপর যে প্রতিক্রিয়া ঘটে তার শেষ ফল। পাঠ পরিকল্পনার (Lesson Plan) গঠন এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে Bining and Bining বলেছেন, “Daily Lesson Planning involves defining the objectives, selecting and arranging the subject matter and determining the method and proceduce.”। Shipley -এর মতে পাঠটীকার সংজ্ঞা হল, “পাঠটীকা শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পূর্বে শিক্ষককৃত এমন একটি অগ্রিম পরিকল্পনা যার ভিত্তিতে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেন।”
L.K. Devies শিখন প্রক্রিয়ায় চারটি পর্যায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। এই চারটি প্রক্রিয়া হল— Planning, Organising, Leading and Controlling । এই চারটির মধ্যে তিনি আবার Planning -কেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। শিক্ষাবিদ Ryburn -এর মতে, পাঠ পরিকল্পনার ফলে ছাত্র ও শিক্ষক উভয়েই লাভবান হন এবং এর দ্বারা একজন শিক্ষক সুষ্ঠুভাবে পাঠ দিতে সক্ষম হন।
পাঠ পরিকল্পনার প্রয়ােজনীয়তা (Need of Lesson Plan)
প্রতিটি কাজের সাফল্য নির্ভর করে উপযুক্ত পরিকল্পনার ওপর। শিক্ষাদান কাজের সাফল্য নির্ভর করে উপযুক্ত পূর্ব পরিকল্পনার ওপর। শিক্ষক একাধারে একজন শিল্পী। শিল্পী হিসাবেও তার কাজের সাফল্য নির্ভর করে কাজটি সম্পর্কে পূর্ব পরিকল্পনার ওপর। যেহেতু শিক্ষাদান এক বিশেষ ধরনের পরীক্ষণ (experiment) তাই শিক্ষক কাজের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে পাঠদানে অগ্রসর হবেন। সেজন্য প্রয়ােজনীয় উপকরণ ও কৌশল অবলম্বন করবেন। উত্তম পাঠদানের জন্য একটি সার্থক পাঠ পরিকল্পনা (Lesson Plan) প্রস্তুত করা দরকার।
পাঠ পরিকল্পনা শিক্ষককে নির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করে। তাই শিক্ষা প্রক্রিয়াতে পাঠ পরিকল্পনা একান্ত জরুরি। ইতিহাসের অনেক শিক্ষক আছে যারা শ্রেণিকক্ষে চিরাচরিত পদ্ধতিতে ছাত্রদের মুখস্থ করান। ফলে ছাত্রদের মধ্যে ইতিহাস সম্পর্কে যতখানি আগ্রহ জন্মানো দরকার তা হয় না। যেসব শিক্ষার্থী মুখস্থ করতে পারে না তাদের বরং ইতিহাস সম্পর্কে একটা বিতৃষা জন্মায়। তাই ইতিহাসের পাঠ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সুফলগুলি হল—
- পাঠ পরিকল্পনার ফলে শিক্ষণের উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষক অবহিত হাতে পারেন।
- শ্রেণিকক্ষের অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে এনে পাঠ পরিকল্পনা শিক্ষণ প্রক্রিয়াকে যথেষ্ট কার্যকরী করে তুলতে সক্ষম হয়।
- পাঠ পরিকল্পনার পাঠক্রমের প্রতিটি একককে অত্যন্ত সহজভাবে স্মরণ করতে বা বুঝতে সাহায্য করে।
- পাঠ পরিকল্পনা রচিত হয় শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় শ্রেণি শৃঙ্খলা, প্রেষণা ও ব্যক্তিগত বৈষম্যকে ভিত্তি করে।
পাঠ পরিকল্পনার নীতি (Principles of Lesson Plan)
পাঠ তৈরি করা একটি জটিল কাজ। পাঠ পরিকল্পনাকালে শিক্ষকদের কতকগুলি নীতি মনে রাখতে হবে।
- পাঠ পরিকল্পনার প্রথম নীতি হল, যে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক পাঠ পরিকল্পনা রচনা করবেন সে বিষয়টি সম্বন্ধে তার গভীর জ্ঞান থাকা দরকার।
- যে বিষয়টি ওপর তিনি পরিকল্পনা রচনা করবেন তার সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়েও শিক্ষকের যথেষ্ট জ্ঞান থাকা দরকার।
- পাঠ পরিকল্পনা রচনা করতে গেলে শিক্ষককে পাঠের প্রকৃত উদ্দেশ্য জানতে হবে। কারণ পাঠটির মাধ্যমে শিক্ষার্থী কী কী বিষয় লাভ করবে, কী কী জ্ঞান অর্জন করবে, তা জানতে হবে।
- পাঠ পরিকল্পনা রচনা করতে গেলে শিক্ষককে জানতে হবে পাঠ্য বিষয় উপস্থাপনের নানা কৌশল (যথা — প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি, অভিনয় পদ্ধতি, গল্পা বলা পদ্ধতি, সক্রিয়তাভিত্তিক পদ্ধতি, আলােচনা পদ্ধতি প্রভৃতি)।
- পাঠ পরিকল্পনা রচনা করতে গেলে শিক্ষার্থীদের প্রয়ােজন আগ্রহ, বয়সভেদে শিক্ষা গ্রহণের ক্ষমতার ওপর লক্ষ রাখতে হবে।
- পাঠ পরিকল্পনা রচনা করতে গেলে শিক্ষা ঘণ্টার দৈর্ঘ্যের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। বিদ্যালয়ে শিক্ষা ঘণ্টার দৈর্ঘ্য হল ৪০ মিনিট বা ৪৫ মিনিট। পাঠ পরিকল্পনার শিক্ষা ঘণ্টা জেনে পাঠ পরিকল্পনা রচনা করতে হবে।
- পাঠ পরিকল্পনা রচনা করার সময় শিক্ষককে মনে রাখতে হবে যে, প্রত্যেকটি পাঠই একটি নতুন ধরনের পরীক্ষণ, একই ধরনের ছক সব শ্রেণির জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে। শিক্ষককে মনে রাখতে হবে, পাঠ পরিকল্পনা যতই নিখুঁত হােক না কেন তাকে কোনাে মতেই সর্বশ্রেষ্ঠ পাঠ বলা যাবে না। কারণ মনে রাখতে হবে যে, Even the best lesson can be improved.।
পাঠ পরিকল্পনার সুবিধা (Advantages of Lesson Plan)
Lesson Plan বা পাঠ পরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় আমরা যে সুবিধাগুলি পাই সেগুলি নিম্নে উল্লেখ করা হল—
মনােবিভাগ ভিত্তিক শিক্ষাদান : শিক্ষককে পাঠটীকা তৈরির আগেই শিক্ষণ কৌশল, পদ্ধতি ও শিক্ষার উপকরণ ব্যবহার সম্পর্কে চিন্তা করে নিতে হবে। শিক্ষকের এই চিন্তার পিছনে ছাত্রদের আগ্রহ, রুচি, দক্ষতা, সামর্থ্য ইত্যাদি বিচার করতে হয়। শিক্ষার্থীরা এভাবে মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে পাঠ গ্রহণের সুযােগ পায়।
কার্যকারী উপকরণের প্রস্তুতি : পাঠকে মনােগ্রাহী, চিত্তাকর্ষক ও আনন্দময় করে তােলার জন্য কোন্ কোন্ উপকরণ সুবিধাজনক তা শিক্ষককে আগেই চিন্তা করে নিতে হবে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা বিশেষভাবে উপকৃত হয়।