কিন্ডারগার্টেন (Kindergarten) শিক্ষা পদ্ধতির প্রতিষ্ঠাতা হলেন জার্মান শিক্ষাবিদ ফ্রয়বেল (Froebel)। তার শিক্ষাদর্শনকে বাস্তবায়িত করার জন্য তিনি এক বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং এই বিদ্যালয় থেকেই তাঁর অনুসৃত পদ্ধতির নাম হয়েছে কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতি।
কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতি : কিন্ডারগার্টেনের জনক ফ্রয়বেল পেস্তালসীর শিক্ষাচিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শিশুশিক্ষার জগতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। দার্শনিক মতবাদের দিক থেকে তিনি ছিলেন ভাববাদী। তিনি এই দৃশ্যমান জগতের সমস্ত বৈচিত্র্যের মূলে এক অখণ্ড আধ্যাত্মিক সত্তার অস্তিত্বকে উপলব্ধি করা শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য বলে মনে করেছেন।
তাঁর মতে শিক্ষার কাজ হল শিশুকে আত্মােপলব্ধিতে সাহায্য করা। আর শিশুর এই আত্মােপলব্ধি তার বিভিন্ন শ্রমবিকাশের স্তরের মধ্যে দিয়ে ঘটে থাকে। শিশু যত বড় হয় ততই তার অন্তরপ্রকৃতি ধীরে ধীরে উন্মােচিত হতে থাকে। তিনি শিশুর এই ক্রমবিকাশের নাম দিয়েছেন উন্মোচন।
যাহােক, তিনি শিক্ষালয় কথাটিকে ব্যবহার করতে চাননি। তবে তার কিন্ডারগার্টেন কথার অর্থ হল শিশু উদ্যান (children garten)। এরজন্য তিনি আত্মসক্রিয়তাকেই শিশুশিক্ষার একমাত্র পদ্ধতি ভেবেছেন।
শিশুদের তিনি বাগানের ছােট ছােট চারাগাছের সাথে তুলনা করেছেন, আর শিক্ষককে তুলনা করেছেন বাগানের মালির সাথে। তিনি ভাবেন যে শিশুর স্বাভাবিক বিবর্তন ধারাকে অনুসরণ করেই শিক্ষা অগ্রসর হবে।
বস্তুত পেস্তালসী শিশুর ইন্দ্রিয় চেতনা ও প্রত্যক্ষ জীবন অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে যে বস্তুভিত্তিক পাঠদান পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন — তারই সংস্কার সাধন করে ফ্রয়বেল শিশুদের জন্য কতকগুলি ‘উপহার’ (Gifts) ও ‘কাজের’ (Occupations) ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি শিশুর আত্মসক্রিয়তার ওপর এত প্রাধান্য দিয়েছিলেন যে তার শিক্ষা পদ্ধতিকে ‘আত্মসক্রিয়তা পদ্ধতি’ বলা হয়ে থাকে।
কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতির ইতিবাচক দিক : প্রথমত, তার মতে খেলার মধ্যে দিয়েই শিশুর আত্মসক্রিয়তার স্বাভাবিক ও পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে থাকে। আর সেজন্যই তিনি খেলাকে শিক্ষার অপরিহার্য মাধ্যম ভেবেছেন। আর তাই খেলার মধ্য দিয়েই শিশুর সামাজিকীকরণকে মূর্ত করে তুলেছেন।
দ্বিতীয়ত, ফ্রয়বেল প্রবর্তিত K.G. বা কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতির উল্লেখযােগ্য উপহারগুলি হল — বল, কাঠের গােলক, সিলিন্ডার, প্রিজম, কাঠের টুকরাে, দড়ি ইত্যাদি। এর প্রতিটিই ছিল এক একটি বিশেষ ধারণার প্রতীক; যেমন ‘বল’ হচ্ছে আধ্যাত্মিক একতা বা ঈশ্বরের প্রতীক। এগুলাের সাহায্যে তিনি শিশুর মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশ ঘটাতে চেয়েছেন। আর সেজন্যই প্রতিটি উপহারের সাথে একটা করে দার্শনিক ব্যাখ্যা যােগ করেছেন।
তৃতীয়ত, তিনি হাতের কাজের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন। কাদা, বালি, কাঠের গুড়া ও টুকরাে প্রভৃতি নিয়ে শিশুরা নানা রকম জিনিস তৈরির মধ্যে তাদের সৃজনীশক্তি বিকাশ ঘটায়।
চতুর্থত, তিনি অঙ্কনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। অঙ্কনের মধ্যে কেবল রেখা ও রংয়ের ধারণাই জন্মে না — সুন্দর কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটিয়ে শিশুদের কল্পনাপ্রবণ করে তােলে।
শিশুরা স্বভাবতই কাল্পনিক জগতের অধিবাসী। তিনি পঠন ও গল্প বলার ওপরও জোর দিয়েছেন। তার প্রবর্তিত পাঠক্রমে স্থান পেয়েছে — ধর্মচেতনা, ধর্মীয় শিক্ষা, প্রকৃতি বিজ্ঞান ও গণিত, ভাষা, অঙ্কন, শিল্পকর্ম, সৌন্দর্যানুভূতি ও হাতের কাজ প্রভৃতি।
মন্তব্য : পরিশেষে সিদ্ধান্ত টেনে বলতে হয় যে প্রতিটি শিক্ষার্থীর কাছে বিদ্যালয় হবে ক্ষুদ্রতর পৃথিবীর তথা সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ। আর শিক্ষকের দায়িত্ব হল শিশুর স্বাভাবিক ক্ষমতার আবিষ্কার ও প্রতিবন্ধকতা অপসরণে সহায়তা করা। তার মতে সামাজিক পরিবেশই হবে প্রকৃত শিক্ষার পটভূমি — আর শিক্ষা একটি সামাজিক কাজ এবং বিদ্যালয় হচ্ছে সামাজিক জীবনের কেন্দ্র।