শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ সমগ্র বাংলাকে এক শাসনাধীনে এনে দিল্লির নিয়ন্ত্রণমুক্ত এক স্বাধীন বাংলার প্রতিষ্ঠা করেন। শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ প্রতিষ্ঠিত ইলিয়াস শাহী বংশ প্রায় ১৫০ বছর ধরে বাংলা শাসন করে। ১৩৪২ সালে তিনি লাখনৌতির সিংহাসনে বসেন। ১৩৪২ থেকে ১৫৭৬ সালে মোগল বাদশাহ আকবরের বঙ্গ বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত বাংলা ছিল দিল্লির অধীনতামুক্ত একটি স্বাধীন রাজ্য। স্যার যদুনাথ সরকার বলেন, ইলিয়াস শাহের লক্ষণাবতীর সিংহাসনে আরোহণের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার ইতিহাসে এক নব যুগের সূচনা হয়। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ ইলিয়াস শাহ বংশ নামে পরিচিত।
প্রথম জীবন: ইলিয়াস শাহের প্রথম জীবন সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। আরবী ঐতিহাসিক ইবন হজর ও আল সখাই পন্ডিতদের মতে তার আদি নিবাস ছিল পূর্ব ইরানের সিজিস্থান। তার পত্নী ছিলেন ফুলমতি বেগম। লখনৌতির শাসনকর্তা আলী মুবারকের শাসনকালে তিনি বাংলাদেশে আসেন এবং তিনি ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে আলি মুবারককে হত্যা করে লখনৌতির সিংহাসনে বসেন। তার রাজত্বকাল সম্পর্কে জানা যায়, তারিখ-ই-ফিরোজশাহী, তবকাত-ই-আকবরী, তারিখ-ই-ফিরিশতা, সিরাত-ই-ফিরোজশাহী প্রভূতি গ্রন্থ থেকে।
রাজ্য বিস্তার: শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ সাতগাঁও জয় করেন। ইকতিয়ারুদ্দিন গাজি শাহের কাছ থেকে ১৩৫২ সালে সোনারগাঁও অধিকার করেন। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ উত্তর বিহার বা ত্রিহুত জয় করেন এবং হাজীপুর পর্যন্ত অগ্রসর হন। চম্পারণ, গোরক্ষপুর ও বারাণসী দখল করেন। ১৩৪৬ সালে তিনি নেপাল আক্রমণ করে কাঠমান্ডু পর্যন্ত অগ্রসর হন। ১৩৫০ সালে নেপালের বিখ্যাত পশুপতিনাথের মূর্তিটি তিন টুকরো করেন। তার এই অভিযানের উদ্দেশ্যে ছিল লুণ্ঠন। এরপর শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ উড়িষ্যা অভিযান করেন। উড়িষ্যার ভিতর দিয়ে তিনি চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত অগ্রসর হন।
রাজধানী স্থানান্তর: বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের সময় থেকে লাখনৌতি ছিল মুসলিম বাংলার রাজধানী। ইলিয়াস শাহ লাখনৌতির কিছু দূরে মহানন্দা ও কালিন্দী নদীর সঙ্গমস্থলে পান্ডুয়াতে ইলিয়াস শাহ রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। নদীর গতিপথ পরিবর্তন ফলে নগরটি অস্বাস্থ্যকর ও বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এইসব কারণে সুলতান ইলিয়াস শাহ রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
দিল্লির সঙ্গে সংঘর্ষ: ইলিয়াস শাহের শক্তি বৃদ্ধিতে ভীত হয়ে দিল্লির সুলতান ফিরোজ তুঘলক বিশাল বাহিনী নিয়ে ১৫৫৩ সালে বাংলাদেশ আক্রমণ করেন। জিয়াউদ্দিন বরণী এবং শামস-ই-সিরাজ আফিফ এর রচনায় এই এর বিবরণ পাওয়া যায়। ফিরােজ তুঘলক চম্পারণ, গােরক্ষপুর, ত্রিহুত প্রভৃতি স্থানের মধ্য দিয়ে এসে খরস্রোতা কোশী নদী পার হয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন এবং অতি সহজেই রাজধানী পাণ্ডুয়া দখল করেন। ইলিয়াস শাহ সুলতানি বাহিনীর সঙ্গে কোনও সংঘর্ষে না গিয়ে সপরিবারে রাজধানী পাণ্ডুয়ার অদূরে চারিদিকে নদী ও দুর্ভেদ্য জঙ্গলবেষ্টিত একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ফিরােজ তুঘলক একডালা দুর্গ অবরােধ করেন। কয়েকমাস অবরােধের পরেও দুর্গের পতন ঘটানাে সম্ভব হল না।
ইতিমধ্যে বর্ষা এসে যাওয়ায় দিল্লির সেনাবাহিনীর পক্ষে মশা, মাছি, সাপ ও কাদা উপেক্ষা করে আর বাংলায় থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই সুলতান তার সেনাবাহিনীকে পাণ্ডুয়ার দিকে পিছু হটার নির্দেশ দিলে ইলিয়াস শাহ মনে করেন যে, সুলতানি সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাচ্ছে। এমতাবস্থায় তিনি দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসে সুলতানি বাহিনীর উপর আক্রমণ হানলে তার প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং তিনি পরাজিত হয়ে আবার একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন। ঐতিহাসিক আফিফ বলেন যে, ফিরােজ দুর্গ আক্রমণের উদ্যোগ নিলে মুসলিম মহিলারা দুর্গের ছাদে উঠে মাথার কাপড় খুলে কাঁদতে লাগলে ফিরােজ বিচলিত হন। মুসলিম নিধন ও মহিলাদের অমর্যাদা করতে অনিচ্ছুক ফিরােজ দুর্গ অধিকারের পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার এর মতে, এই সমস্ত কথা একেবারেই বিশ্বাসযােগ্য নহে। শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়, বাংলার স্বাধীনতা স্বীকৃত হয় এবং কোশী নদী উভয় পক্ষের মধ্যবর্তী সীমানা বলে চিহ্নিত হয়।
Advertisement
কামরূপ অভিযান: দিল্লির সঙ্গে শান্তি স্থাপনের পর ১৩৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ব্রহ্মপুত্র অতিক্রম করে কামরূপ (বর্তমান আসাম) আক্রমণ করেন এবং এর কিছু অংশ জয় করেন। সেখানে তিনি একটি মুদ্রাশালা স্থাপন করেন। সিকান্দার শাহের লিপিতে এই মুদ্রাশালার উল্লেখ আছে। ১৩৫৭ বা ১৩৫৮ খ্রিস্টানে তার মৃত্যু হয়।
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের কৃতিত্ব: বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মধ্য ইলিয়াস শাহ অন্যতম ছিল। তিনি প্রথম মুসলিম সুলতান সমগ্র বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ করেন। তিনি হিন্দু মুসলিম সবার প্রিয় একজন জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। ঐতিহাসিক শামস্-ই-সিরাজ আফিফ তাকে শাহ-ই-বাঙ্গলা, সুলতান-ই-বাঙ্গালা, শাহ-ই-বাঙ্গালীয়ানা উপাধি দিয়েছেন। ডঃ আবদুল করিম বলেন যে, এইসব উপাধিগুলি থেকেই বােঝা যায় যে, তিনি কেবলমাত্র মুসলিমদের সুলতান ছিলেন না, হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকল বাঙালির সুলতান ছিলেন। দিল্লির বেতনভােগী ঐতিহাসিকরা অবশ্য তাকে ভাঙখাের ও কুণ্ঠরােগী রূপে চিত্রিত করেছেন। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন যে, ইহা ইলিয়াসের শত্রুপক্ষের লােকের বিদ্বেষপ্রণােদিত মিথ্যা উক্তি বলিয়া মনে হয়। পির ও দরবেশদের প্রতি তার প্রবল শ্রদ্ধা ছিল। এই সময় বাংলাদেশে তিনজন বিখ্যাত মুসলিম সন্ত বাস করতেন। তারা হলেন অখী সিরাজউদ্দিন, আলা-উল-হক এবং রাজা বিয়াবানি। তার আমলে শিল্প স্থাপত্যে পাণ্ডুয়া খ্যাতি অর্জন করে। বলা হয় যে, তিনি হাজিপুর নগর এবং ফিরােজাবাদ বা আদিনায় একটি জলাশয় খনন করেন। এইসব আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বাংলার মুসলিম সুলতানদের মধ্যে ইলিয়াস শাহ একজন শ্রেষ্ঠ নরপতি ছিলেন।
![]() |
Image - Wikipedia |
রাজ্য বিস্তার: শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ সাতগাঁও জয় করেন। ইকতিয়ারুদ্দিন গাজি শাহের কাছ থেকে ১৩৫২ সালে সোনারগাঁও অধিকার করেন। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ উত্তর বিহার বা ত্রিহুত জয় করেন এবং হাজীপুর পর্যন্ত অগ্রসর হন। চম্পারণ, গোরক্ষপুর ও বারাণসী দখল করেন। ১৩৪৬ সালে তিনি নেপাল আক্রমণ করে কাঠমান্ডু পর্যন্ত অগ্রসর হন। ১৩৫০ সালে নেপালের বিখ্যাত পশুপতিনাথের মূর্তিটি তিন টুকরো করেন। তার এই অভিযানের উদ্দেশ্যে ছিল লুণ্ঠন। এরপর শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ উড়িষ্যা অভিযান করেন। উড়িষ্যার ভিতর দিয়ে তিনি চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত অগ্রসর হন।
রাজধানী স্থানান্তর: বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের সময় থেকে লাখনৌতি ছিল মুসলিম বাংলার রাজধানী। ইলিয়াস শাহ লাখনৌতির কিছু দূরে মহানন্দা ও কালিন্দী নদীর সঙ্গমস্থলে পান্ডুয়াতে ইলিয়াস শাহ রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। নদীর গতিপথ পরিবর্তন ফলে নগরটি অস্বাস্থ্যকর ও বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এইসব কারণে সুলতান ইলিয়াস শাহ রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
দিল্লির সঙ্গে সংঘর্ষ: ইলিয়াস শাহের শক্তি বৃদ্ধিতে ভীত হয়ে দিল্লির সুলতান ফিরোজ তুঘলক বিশাল বাহিনী নিয়ে ১৫৫৩ সালে বাংলাদেশ আক্রমণ করেন। জিয়াউদ্দিন বরণী এবং শামস-ই-সিরাজ আফিফ এর রচনায় এই এর বিবরণ পাওয়া যায়। ফিরােজ তুঘলক চম্পারণ, গােরক্ষপুর, ত্রিহুত প্রভৃতি স্থানের মধ্য দিয়ে এসে খরস্রোতা কোশী নদী পার হয়ে বাংলায় প্রবেশ করেন এবং অতি সহজেই রাজধানী পাণ্ডুয়া দখল করেন। ইলিয়াস শাহ সুলতানি বাহিনীর সঙ্গে কোনও সংঘর্ষে না গিয়ে সপরিবারে রাজধানী পাণ্ডুয়ার অদূরে চারিদিকে নদী ও দুর্ভেদ্য জঙ্গলবেষ্টিত একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ফিরােজ তুঘলক একডালা দুর্গ অবরােধ করেন। কয়েকমাস অবরােধের পরেও দুর্গের পতন ঘটানাে সম্ভব হল না।
ইতিমধ্যে বর্ষা এসে যাওয়ায় দিল্লির সেনাবাহিনীর পক্ষে মশা, মাছি, সাপ ও কাদা উপেক্ষা করে আর বাংলায় থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়েই সুলতান তার সেনাবাহিনীকে পাণ্ডুয়ার দিকে পিছু হটার নির্দেশ দিলে ইলিয়াস শাহ মনে করেন যে, সুলতানি সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাচ্ছে। এমতাবস্থায় তিনি দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসে সুলতানি বাহিনীর উপর আক্রমণ হানলে তার প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং তিনি পরাজিত হয়ে আবার একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন। ঐতিহাসিক আফিফ বলেন যে, ফিরােজ দুর্গ আক্রমণের উদ্যোগ নিলে মুসলিম মহিলারা দুর্গের ছাদে উঠে মাথার কাপড় খুলে কাঁদতে লাগলে ফিরােজ বিচলিত হন। মুসলিম নিধন ও মহিলাদের অমর্যাদা করতে অনিচ্ছুক ফিরােজ দুর্গ অধিকারের পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার এর মতে, এই সমস্ত কথা একেবারেই বিশ্বাসযােগ্য নহে। শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়, বাংলার স্বাধীনতা স্বীকৃত হয় এবং কোশী নদী উভয় পক্ষের মধ্যবর্তী সীমানা বলে চিহ্নিত হয়।
শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের কৃতিত্ব: বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মধ্য ইলিয়াস শাহ অন্যতম ছিল। তিনি প্রথম মুসলিম সুলতান সমগ্র বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ করেন। তিনি হিন্দু মুসলিম সবার প্রিয় একজন জনপ্রিয় শাসক ছিলেন। ঐতিহাসিক শামস্-ই-সিরাজ আফিফ তাকে শাহ-ই-বাঙ্গলা, সুলতান-ই-বাঙ্গালা, শাহ-ই-বাঙ্গালীয়ানা উপাধি দিয়েছেন। ডঃ আবদুল করিম বলেন যে, এইসব উপাধিগুলি থেকেই বােঝা যায় যে, তিনি কেবলমাত্র মুসলিমদের সুলতান ছিলেন না, হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকল বাঙালির সুলতান ছিলেন। দিল্লির বেতনভােগী ঐতিহাসিকরা অবশ্য তাকে ভাঙখাের ও কুণ্ঠরােগী রূপে চিত্রিত করেছেন। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন যে, ইহা ইলিয়াসের শত্রুপক্ষের লােকের বিদ্বেষপ্রণােদিত মিথ্যা উক্তি বলিয়া মনে হয়। পির ও দরবেশদের প্রতি তার প্রবল শ্রদ্ধা ছিল। এই সময় বাংলাদেশে তিনজন বিখ্যাত মুসলিম সন্ত বাস করতেন। তারা হলেন অখী সিরাজউদ্দিন, আলা-উল-হক এবং রাজা বিয়াবানি। তার আমলে শিল্প স্থাপত্যে পাণ্ডুয়া খ্যাতি অর্জন করে। বলা হয় যে, তিনি হাজিপুর নগর এবং ফিরােজাবাদ বা আদিনায় একটি জলাশয় খনন করেন। এইসব আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বাংলার মুসলিম সুলতানদের মধ্যে ইলিয়াস শাহ একজন শ্রেষ্ঠ নরপতি ছিলেন।
Advertisement