সুইজারল্যান্ডের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য কি?
Sign Up to our social questions and Answers Engine to ask questions, answer people's questions, and connect with other people.
Login to our social questions & Answers Engine to ask questions answer people's questions & connect with other people.
Mustafa
পৃথিবীর সকল দেশের শাসনব্যবস্থায় কতকগুলি বৈশিষ্ট্য আছে, যা জাতীয় জীবনের উত্থান পতনের প্রবাহমান ধারায় সমতলে বিবর্তিত হয়ে দেশের প্রগতির পথ প্রশস্ত করেছে এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য দেশ হতে তার বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট করেছে। সুইজারল্যান্ডের শাসনব্যবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। সুতরাং সুইজারল্যান্ডের শাসনতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করলেই আমরা অন্যান্য শাসনব্যবস্থার সঙ্গে সুইস শাসনব্যবস্থার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য উপলব্ধি করতে পারব।
(১) যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা : সুইস শাসনতন্ত্রের (১৮৭৪) সুইজারল্যান্ড রাষ্ট্র সমবায় (Confederation) বলে বর্ণিত হলেও কার্যত এর প্রকৃতি যুক্তরাষ্ট্রীয় বলা যেতে পারে। ২৩ টি ক্যান্টন (Canton) নিয়ে সুইস যুক্তরাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। প্রত্যেক ক্যান্টনের পক্ষে শাসনতন্ত্র ও নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক বৈশিষ্ট্যের স্বীকৃতির ওপর যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সুতরাং যে নামেই অভিহিত হােক না কেন, সুইজারল্যাণ্ড হল প্রকৃত একটি যুক্তরাষ্ট্র।
(২) লিখিত শাসনতন্ত্র — অলিখিত প্রথা : সুইজারল্যাণ্ডের শাসনতন্ত্র আমেরিকা, রাশিয়া এবং ভারতের ন্যায় লিখিত। এটি আকারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিগুণ। শাসনতন্ত্র লিখিত হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় অলিখিত প্রথা ও রীতিনীতির প্রভাব রয়েছে। যেমন নাগরিকত্ব অর্জনের নিয়মাবলী রচনার ক্ষমতা আইনতঃ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকলেও বাস্তবে ক্যান্টন সরকারগুলি এই ক্ষমতা পরিচালনা করে। সুইজারল্যান্ডে ক্যান্টনের নাগরিকত্ব লাভ করলেও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া যায়।
(৩) ক্ৰমবিবর্তনের ফল : সুইজারল্যান্ডের শাসনব্যবস্থা দীর্ঘ ছয়শত বৎসর ধরে ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে। অন্যান্য যুক্তরাষ্ট্রের সুইস শাসনতন্ত্র কোন বিশেষ সভা বা গণপরিষদ কর্তৃক রচিত হয় নি। ব্রিটেনের শাসনতন্ত্রও দীর্ঘদিনের ফল বলা যায়; কিন্তু এই বিবর্তনের মাধ্যমে ব্রিটেনে সুইজারল্যাণ্ডের ন্যায় যুক্তরাষ্ট্র ও লিখিত শাসনতন্ত্র প্রবর্তিত হয় নি।
(৪) প্রজাতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র : সুইজারল্যাণ্ডের শাসনতন্ত্র প্রজাতান্ত্রিক (Republican)। শুধু কেন্দ্র নয়, ক্যান্টনগুলিতেও অন্য কোন ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হতে পারে না। রাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা সুইস জনগণের নিকট সম্পূর্ণ অপরিচিত। তাদের মতে, রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব কোন নির্বাচিত ব্যক্তির বা উত্তরাধিকারীর নয়, এটি সম্পূর্ণভাবে নাগরিকের অধিকার। সুইজারল্যাণ্ডই পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা পুরাতন প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেছে।
(৫) কেন্দ্রমুখীনতা : অধ্যাপক Strong বলেন, সুইজারল্যাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলেও তা পূর্ণ রূপ লাভ করতে পারে নি। শাসনতন্ত্রের তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ক্যান্টনগুলির সার্বভৌমত্ব যতদূর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনতন্ত্র দ্বারা সীমাবদ্ধ হয় নি, ক্যান্টনগুলি ততদূর পর্যন্ত সার্বভৌম, এবং যে সকল ক্ষমতা তারা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের নিকট হস্তান্তরিত করে নি তা তাদেরই ক্ষমতা। সুইজারল্যাণ্ডের এই ব্যবস্থা অনেকের মতে জাতীয় ঐক্যকে হ্রাস করেছে। অন্যদিকে ক্যান্টনগুলির শাসনতন্ত্রের সংরক্ষণের ভার কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর অর্পণ করে ক্যান্টনগুলিকে কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল করে তােলা হয়েছে। ৪টি গুরত্বপূর্ণ বিষয়ের জন্যে সুইস শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীকরণ ঘটেছে বলা হয়। যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা, সমাজকল্যাণকর কাজের জন্যে চাহিদা এবং পরিবহন ও শিল্পে প্রযুক্তিগত বিপ্লব। অবশ্য এই বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর অনানি যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যায়।
(৬) প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র : সুইজারল্যাণ্ডকে গণতন্ত্রের আবাসভূমি বলা যেতে পারে। ক্যান্টনগুলির অধিকার গণভােট পদ্ধতির মাধ্যমে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোন ক্যান্টনের অধিবাসীগণ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভােট দাবী করলে কেন্দ্রীয় সরকার ঐ ক্যান্টনের শাসনতন্ত্র অথবা শাসনতন্ত্র সংশােধন মেনে নিতে বাধ্য। গণভােট ছাড়া, গণ-সমাবেশ (Landsgemeinde) ও গণ-উদ্যোগের ব্যবস্থা আছে। এই প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি সুইস শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। গণতন্ত্র এবং সুইজারল্যাণ্ড প্রায় সমার্থবােধক শব্দে পরিণত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষের দ্বারা নিজেদের শাসনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সুইজারল্যান্ডের মত পৃথিবীর অন্য কোন রাষ্ট্রেই স্বীকৃত হয় নি। লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) বলেছেন, “পৃথিবীর আধুনিক গণতন্ত্রের মধ্যে যাদের সত্যকার গণতন্ত্র বলে আখ্যা দেওয়া যেতে পারে, তাদের মধ্যে সুইজারল্যাণ্ডের পঠনপাঠনের দাবী সর্বাধিক। ইউরােপের অন্য কোন রাষ্ট্র অপেক্ষা সুইজারল্যান্ডের গণতান্ত্রিক নীতিগুলি অধিক সংখ্যায় সামঞ্জস্যের সঙ্গে কার্যকর হয়েছে”।
(৭) মৌলিক অধিকার : সুইস শাসনতন্ত্রে মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত কোন বিশেষ অধ্যায় সংযােজিত না হলেও শাসনতন্ত্রের বিভিন্ন ধারায় নাগরিকগণের কতকগুলি অধিকার সংরক্ষিত হয়েছে। আইনের দৃষ্টিতে সাম্য, ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা, মুদ্রণযন্ত্রের স্বাধীনতা, সংঘ গঠন ও আবেদন করবার অধিকার সুইস নাগরিকগণ ভােগ করে। অবশ্য ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতার কতকগুলি ক্ষেত্রে সীমারেখা টানা হয়েছে।
(৮) উচ্চকক্ষ গঠনে ক্যান্টনগুলির অধিকার : সুইজারল্যাণ্ডের যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার উচ্চকক্ষে প্রতি ক্যান্টন থেকে দুজন করে প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা আছে। প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ক্যান্টনের মধ্যে কোন নীতিগত ঐক্য নেই। প্রতিনিধি মনােনয়নের পদ্ধতি সম্পর্কে ক্যান্টনগুলির স্বাধীনতা আছে।
(৯) যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার উভয় কক্ষ সমক্ষমতাসম্পন্ন : সুইজারল্যাণ্ডের যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার উভয়কক্ষই ক্ষমতাসম্পন্ন। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে উভয়ের সমানাধিকার রয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে আইনসভার উভয় কক্ষকে এইরূপ সমানাধিকার দেওয়া হয় নি। এটি সুইজারল্যান্ডের শাসনতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
(১০) ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিশেষ প্রতিফলন নেই : সুইজারল্যাণ্ডের শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বিশেষ অনুসৃত হয় নি। আইনসভার ওপর শাসন ও বিচার সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। আইনসভা যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনকর্তাগণকে নির্বাচিত করে। যুক্তরাষ্ট্রীয় বিচারালয়ের বিচারপতি ও অন্যান্য সরকার কর্মচারীগণকে নিযুক্ত করে। তা ছাড়াও অন্যান্য অনেক দায়িত্বপূর্ণ কাজ আইনসভা সম্পাদন করে থাকে।
(১১) বিশেষ ধরনের শাসন বিভাগ : সুইজারল্যাণ্ডের শাসনব্যবস্থার আর একটি বৈশিষ্ট্য হল যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন পরিষদ। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসক প্রধান সুইজারল্যাণ্ডে একজনের পরিবর্তে ৭ জনের একটি পরিষদ (Collegial Executive) এবং তত্ত্বগতভাবে এই পরিষদ সম্পূর্ণভাবে আইনসভার অধীন। সম্মিলিত পরিষদের একজন সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন এবং তিনিই আনুষ্ঠানিক ব্যাপার রাষ্ট্র-প্রধানের কাজ করে থাকেন।
(১২) বিচার ব্যবস্থা : সুইস যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত অন্যান্য যুক্তরাষ্ট্রের আদালত হতে পৃথক। যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভার প্রণীত কোন আইনকে অবৈধ বলে ঘােষণা করার ক্ষমতা আদালতের নেই। এই ক্ষমতা নেই বলে সুইজারল্যাণ্ডের সর্বোচ্চ আদালতের শাসনতন্ত্রের বাধ্যবাধকতা ও সংরক্ষক হিসাবে কোন ভূমিকা নেই।
(১৩) ধর্ম নিরপেক্ষতা : সুইজারল্যাণ্ডের সংবিধানে ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা স্বীকার করা হলেও তা কার্যতঃ সীমাবদ্ধ। সংবিধানে Jesuits সম্প্রদায়ের কাজকর্ম নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং পুরােহিত সম্প্রদায়ের যাতে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত না হয় সে বিষয়েও লক্ষ্য রাখা হয়েছে। সুতরাং মােটামুটিভাবে সুইজারল্যান্ডকে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলা চলে।
(১৪) শাসনতন্ত্রের দুম্পরিবর্তনীয়তা : সুইজারল্যাণ্ডের শাসনতন্ত্রের দুষ্পরিবর্তনীয়তা এই শাসনতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অবশ্য সুইস শাসনতন্ত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রের মত দুস্পরিবর্তনীয় নয়। যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা অথবা পঞ্চাশ হাজার নির্বাচকের পক্ষ হতে শাসনতন্ত্র সংশােধনের প্রস্তাব উত্থাপন করা যেতে পারে। এই প্রস্তাবে গণভােটে সমর্থিত হওয়া প্রয়ােজন। গণভােটে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ নির্বাচক এবং ক্যান্টনগুলি প্রস্তাব মেনে নিলে সংশােধন প্রস্তাব শাসনতন্ত্রের অঙ্গীভূত হয়।