সিন্ধু সভ্যতার সামাজিক জীবন কেমন ছিল?
Sign Up to our social questions and Answers Engine to ask questions, answer people's questions, and connect with other people.
Login to our social questions & Answers Engine to ask questions answer people's questions & connect with other people.
Mustafa
বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সাহায্যে হরপ্পা সভ্যতার সমাজ জীবন সম্পর্কে মােটামুটি একটি ধারণা করা যায়। শহরের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ওজন-মাপ প্রভৃতি দেখে মনে হয় যে, এখানে একটি কেন্দ্রীভূত প্রশাসন প্রচলিত ছিল এবং এই কেন্দ্রীয় শক্তিই এই অঞ্চলের জনজীবন পরিচালনা করত। এখানে কী ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত ছিল, তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয় — তবে তা রাজতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র বা পুরােহিততন্ত্র — অনেক কিছুই হতে পারে। সিন্ধু সভ্যতার সমাজ ছিল শ্রেণিবিভক্ত। শহরের ঘরবাড়ি এবং অন্যান্য উপকরণ থেকে তা স্পষ্ট।
শ্রেণিবিভক্ত সমাজ: শ্রেণিবিভক্ত সমাজের অস্তিত্ব হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। শহরের ঘরবাড়ি ও অন্যান্য উপকরণ দেখে মনে হয় যে সমাজে শাসক সম্প্রদায়, ধনী ও ব্যবসায়ী এবং দরিদ্র শ্রমিক ও কারিগরেরা বাস করত। দুর্গ অঞ্চলেই ছিল শাসকদের বাসগৃহ। শহরের দ্বিতল-ত্রিতল গৃহগুলিতে বাস করত ধনী ও মধ্যবিত্ত বণিক সম্প্রদায় এবং খুপরি জাতীয় ঘরগুলি ছিল শ্রমজীবী দরিদ্রদের বাসস্থান। পণ্ডিতরা অনুমান করেন যে, এই শহরগুলিতে ক্রীতদাসরাও ছিল। তারা দীনহীন কুটিরে বাস করত এবং ফসল মাড়াই, ভারী বােঝা বহন, শহরের জঞ্জাল পরিষ্কার প্রভৃতি কাজ করত। মহেঞ্জোদারাে ও হরপ্পা উভয় শহরেরই উত্তর-পূর্ব কোণ, দুর্গপ্রাকার ও শস্যাগারের কাছাকাছি স্থানসমূহে খুপরি-জাতীয় ঘরগুলির অস্তিত্ব শহরে ক্রীতদাস ও দরিদ্র শ্রমজীবীদের উপস্থিতি প্রমাণ করে। কালিবঙ্গান ও লােথালে এ ধরনের কোনও খুপরি মেলেনি বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন যে, এই শহর দুটির শাসকরা হরপ্পা-মহেঞ্জোদারাের শাসকবর্গ অপেক্ষা উদার ছিলেন। অধ্যাপক ব্যাসাম মনে করেন যে, হরপ্পা সভ্যতায় মধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যাধিক্য ছিল।
খাদ্য: সিন্ধু সভ্যতা নগরকেন্দ্রিক হলেও তার মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। শহরগুলির সন্নিহিত গ্রামাঞ্চলে কৃষিকার্য চলত। সিন্ধু নদের বন্যায় কৃষিক্ষেত্র ছিল উর্বর। এখানকার অধিবাসীরা গম, বার্লি, ভাত, ফলমূল, তিল, মটর, রাই, খেজুর, বাদাম, শাক সবজি ও মুরগি, ভেড়া, গরু ও বিভিন্ন পাখির মাংস, দুধ খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করত। মাছ এবং ডিম তাদের খাদ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পশু-পাখি: বিভিন্ন পশুর কঙ্কাল, শিশুদের খেলনা এবং বিভিন্ন সিলে অঙ্কিত চিত্র থেকে হরপ্পার পশু-পাখি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। গৃহপালিত জন্তুর মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল গরু, মহিষ, ভেড়া, উট, হাতি , শূকর ও ছাগল । এছাড়া বাঘ , বাইসন , গণ্ডার, ভল্লুক, খরগােশ তাদের অজানা ছিল না। বেলুচিস্তানে মাটির নীচে অতি গভীরে ঘােড়ার চিহ্ন মিললেও ঘােড়া কিন্তু সেদিন পােষ মানে নি।
পােশাক-পরিচ্ছদ ও অলঙ্কার: সিন্ধুবাসী সুতি ও পশমের বস্ত্র ব্যবহার করত। তারা দেহের ঊর্ধ্বাংশ ও নিম্নাঙ্গ দুইখণ্ড বস্ত্রের দ্বারা আবৃত করত। নারী পুরুষ উভয়েই লম্বা চুল রাখত। মেয়েরা সােনা ও রূপার কিতে দিয়ে নানা ধরনের খোপা করত। তারা নানা ধরনের প্রসাধন সামগ্রী, সুগন্ধি এবং তামা, ব্রোঞ্জ, সােনা, রূপা ও পাথরের তৈরি নানা ধরনের ও নানা আকারের হার, কানের দুল, চুড়ি, আংটি, মল, কোমরবন্ধ ও মালা ব্যবহার করত। সুরমার ব্যবহার তাদের অজানা ছিল না।
গৃহস্থালির সরঞ্জাম: পাথর, মাটি, তামা, সিসা, ব্রোঞ্জ ও কাঠের তৈরি বাসনপত্র ও গৃহস্থালির নানা সরঞ্জাম আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলির মধ্যে বাটি, জগ, মাদুর, খাট, চেয়ার, টুল, আয়না, চিরুনি, কাচি, সুচ, ক্ষুর প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।
অস্ত্রশস্ত্র: তামা, ব্রোঞ্জ ও পাথরের তৈরি কুঠার, বর্শা, তির, ধনুক, মুশল প্রভৃতি অস্ত্রও তারা ব্যবহার করত। এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে সিন্ধু উপত্যকায় ঢাল, বর্ম, শিরস্ত্রাণ প্রভৃতি আত্মরক্ষামূলক অস্ত্রের কোনও সন্ধান মেলেনি।
আমোদ-প্রমোদ: নৃত্য – গীত, পশুশিকার, পাশাখেলা, যাঁড়ের লড়াই ও রথচালনা ছিল তাদের অবসর বিনােদনের উপায়।
সিল ও লিপি: সিন্ধু উপত্যকায় পােড়ামাটি, তামা ও ব্রোঞ্জের প্রচুর সিল আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলির সংখ্যা প্রায় দু’হাজার। পণ্ডিতদের অনুমান প্রধানত ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যই ওইসব সিল তৈরি হয়েছিল এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এগুলি ব্যবহৃত হত, কারণ সুসা এবং মেসােপটেমিয়ার নগরগুলিতেও হরপ্পার সিল আবিষ্কৃত হয়েছে। এইসব সিলে বিভিন্ন জীবজন্তু ও জলযানের চিত্র অঙ্কিত আছে। এ থেকে মনে হয় যে, এইসব জীবজন্তু ও জলযান তাদের সুপরিচিত ছিল। আবার কিছু সিলে কিছু কিছু চিত্র উৎকীর্ণ আছে। হরপ্পাবাসী ছবি এঁকে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করত। এগুলিই হল ‘সিন্ধু লিপি’ বা ‘হরপ্পা লিপি’। এই লিপি চিত্রলিপি — বর্ণলিপি নয়। চিত্রলিপির স্তর অতিক্রম করা সিন্ধু লিপির পক্ষে সম্ভব হয় নি। এইসব লিপি এখনও পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয় নি — তবে এ কথা ঠিক যে, এই লিপি ডানদিক থেকে বাঁদিকে পড়া হত। পণ্ডিতরা এই লিপির সঙ্গে সুমেরীয়, এলামীয়, হিট্রাইট, মিশরীয়, ক্রীটীয়, ব্রাহ্মী, সংস্কৃত প্রভৃতি বহু লিপির সাদৃশ্য লক্ষ করেছেন। সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত এ সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়।