ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনার তাৎপর্য কি?
Sign Up to our social questions and Answers Engine to ask questions, answer people's questions, and connect with other people.
Login to our social questions & Answers Engine to ask questions answer people's questions & connect with other people.
Sujata Shukla
বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লিখিত সংবিধানে প্রস্তাবনা (Preamble) যুক্ত করবার রীতি লক্ষ্য করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ১৭৮৭ সালেই সংবিধান রচয়িতাগণ একটি প্রস্তাবনা যুক্ত করেন। পরবর্তীকালে জাপান, আয়ারল্যান্ড, ব্রহ্মদেশ, ভারত প্রভৃতি দেশের সংবিধানে প্রস্তাবনার সন্নিবেশ দেখতে পাওয়া যায়। এই প্রস্তাবনা যুক্ত করবার একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। যে কোন আইনের সঙ্গে একটি প্রস্তাবনা যুক্ত থাকে; সংবিধান হল মৌলিক আইন। সুতরাং সংবিধানের সঙ্গে প্রস্তাবনা যুক্ত করবার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে। প্রত্যেক সংবিধানের একটি নিজস্ব দার্শনিক ভিত্তি আছে, প্রস্তাবনার মাধ্যমেই সেই দার্শনিক ভিত্তির অর্থাৎ সংবিধানের মৌল উদ্দেশ্য ও নীতির বর্ণনা থাকে। সংবিধান রচয়িতাগণের আদর্শ, লক্ষ্য ও তাদের ইচ্ছা প্রস্তাবনা রূপ লাভ করে। প্রস্তাবনাকে শাসনতন্ত্রের কার্যকরী অংশের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচনা করা হয় না। মার্কিন সুপ্রীম কোর্ট এই বিষয়ে মন্তব্য করেছে যে, যদিও প্রস্তাবনার মধ্যে জনগণের সংবিধান রচনার লক্ষ্য প্রকাশিত হয়, তবু প্রস্তাবনাকে প্রকৃত ক্ষমতার উৎস বলে গণ্য করা যায় না।
বেরুবাড়ি ইউনিয়ন সম্পর্কিত প্রশ্নের আলােচনাকালে সুপ্রীম কোর্ট অভিমত প্রকাশ করে যে, প্রস্তাবনাকে সংবিধানের অংশ বলে বিবেচনা করা যায় না। এবং সরকার বা এর বিভিন্ন বিভাগের মুল ক্ষমতার উৎস হিসাবেও প্রস্তাবনাকে গ্রহণ করা যায় না। প্রস্তাবনাকে সংবিধানের কার্যকরী অংশ হিসাবে গণ্য করতে না পারলেও সংবিধান ব্যাখ্যার সহায়ক হিসাবে এর মূল্য স্বীকার করতে হয়। সংবিধানের কার্যকরী অংশের মধ্যে কোন অস্পষ্টতা বা অসামঞ্জস্য থাকলে মৌলনীতির পরিপ্রেক্ষিতে তার ব্যাখ্যা প্রয়ােজন এবং সেজন্যই প্রস্তাবনার সাহায্য নেওয়া হয়। অবশ্য প্রস্তাবনার সঙ্গে সংবিধানের মূল অংশের অসঙ্গতি বা বিরােধ দেখা দিলে মূল অংশের অর্থই বলবৎ হবে। এই পার্থক্য স্মরণে রেখে ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনার মূল্য বিচার করতে হবে।
ভারতের সংবিধানের মূল প্রস্তাবনা : ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনাটি সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করে এর আলােচনা যুক্তিসঙ্গত। ভারতীয় সংবিধানের মূল প্রস্তাবনার সঙ্গে ১৯৭৬ সালের ৪২ তম সংশােধন আইন দ্বারা কিছু সংযােজিত হয়েছে। ‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র আদর্শ এবং জাতীয় সংহতির কথা প্রস্তাবনার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নতুন সংযােজনসহ প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে :
“We the PEOPLE OF INDIA, having solemnly resolved to constitute India into a SOVEREIGN SOCIALIST SECULAR DEMOCRATIC REPUBLIC and to secure to its citizens:
JUSTICE social, economic and political;
LIBERTY of thought, expression, faith, belief and worship;
EQUALITY of status and of opportunity; and to promote among them all;
FRATERNITY assuring the dignity of the individual and the unity and integrity of the nation;
IN OUR CONSTITUENT ASSEMBLY this twenty sixth day of November, 1949, do HEREBY ADOPT, ENACT and GIVE TO OURSELVES THIS CONSTITUTION.”
“আমরা ভারতের জনগণ ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্ম নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র হিসাবে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথ গ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিকের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম ও উপাসনার স্বাধীনতা; মর্যাদা ও সুযােগ সুবিধার সমতা সৃষ্টি এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তির মর্যাদা ও জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুনিশ্চিত করার জন্য যাতে সৌভ্রাতৃত্বের ভাব গড়ে উঠে, তার জন্য আমাদের গণপরিষদে আজ ১৯৪৯ সালের ২৬ শে নভেম্বর এই সংবিধান গ্রহণ ও বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি”।
ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনার তাৎপর্য
ভারতীয় সংবিধানের এই প্রস্তাবনার বিভিন্ন দিক আলােচনা করলে, সংবিধানের প্রস্তাবনার তাৎপর্য উপলব্ধি করা যাবে।
জনগণ প্রকৃত ক্ষমতার আধার : প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে যে, জনগণই শাসনতন্ত্র গ্রহণ ও বিধিবদ্ধ করে নিজেদের অর্পণ করেছে। অর্থাৎ জনগণই প্রকৃত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। মার্কিন শাসনতন্ত্রেও ভারতের মতাে জনগনকেই ক্ষমতার আধার বলে বর্ণনা করা হয়েছে। শাসনতন্ত্রের আইনগত ভিত্তি হল জনসাধারণ। সুতরাং যে শাসনতন্ত্র জনগণ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে তাকে আইন বলে সকলকে স্বীকার করতে হবে। নৈতিক দিক থেকে এই শাসনতন্ত্র মান্য করবার যুক্তি রয়েছে। শাসনতন্ত্র দেশের মৌলিক আইন, ইহা অমান্য করলে দেশে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। তাছাড়া জনসাধারণ কর্তৃক স্বীকৃত ও গৃহীত আইনকে নীতিগতভাবে জনসাধারণের মান্য করা উচিত।
স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র: ভারতীয় শাসনতন্ত্রের প্রস্তাবনায় বর্ণনা করা হয়েছে যে, ভারত একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র। এই তিনটি শব্দের বিশেষ অর্থ আছে। সার্বভৌম (Sovereign) কথাটির অর্থ হল, ভারত অভ্যন্তরীণ অথবা বহির্ব্যাপারে কোন বিদেশী শাসনের অধীন নয়। ভারত স্বাধীনভাবে অভ্যন্তরীণ নীতি নির্ধারণ করতে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে। ভারতীয় গণপরিষদের ‘উদ্দেশ্য সম্পর্কিত প্রস্তাবে’ (Objective Resolution) ভারতকে স্বাধীন সার্বভৌম, সাধারণতন্ত্র (Independent Sovereign Republic) বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু স্বাধীন শব্দটির মধ্যে স্বাধীনতার তাৎপর্য নিহিত আছে, সুতরাং পুনরায় উল্লেখের প্রয়োজন নেই।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র: প্রস্তাবনায় ‘গণতন্ত্র’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ অনেক ব্যাপক। সাধারণভাবে ভারতীয় শাসনতন্ত্র রাষ্টনৈতিক গণতন্ত্র বা সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তি স্বীকৃত হয়েছে। ভারতের প্রাপ্তবয়স্ক জনসাধারণের ভােটে নির্বাচিত সরকারই শাসন পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে – ইহাই প্রস্তাবনার মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু গণতন্ত্র বলতে শুধু রাষ্ট্রনৈতিক গণতন্ত্র বােঝায় না, অর্থনৈতিক ও সামাজিক গণতন্ত্রও বােঝায়। অর্থনৈতিক সাম্য ব্যতীত রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক গণতন্ত্রের কোন মূল্যই থাকে না। এজন্য ভারতীয় শাসনতন্ত্রে সামাজিক ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করবার আদর্শ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রস্তাবনা ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও সাম্যের আদর্শকে সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মৌলিক অধিকার ও নির্দেশমূলক নীতির মধ্য দিয়ে প্রস্তাবনায় ঘােষিত সাম্য ও ন্যায়ের আদর্শের কার্যকরী রূপ ফুটে উঠবে, সংবিধান প্রণেতাগণ এটাই আশা করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গীতে বিচার করলে প্রস্তাবনায় শুধু সংবিধানের দার্শনিক তত্ত্বই প্রকাশিত হয় নি, বর্তমান পৃথিবীর রাষ্ট্রনৈতিক দর্শনও প্রতিফলিত হয়েছে। বর্তমান যুগের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হিসাবে প্রস্তাবনাটি সার্বজনীনতায় সমৃদ্ধ।
সমাজতন্ত্র: ভারতীয় শাসনতন্ত্রে সমাজতন্ত্রের আদর্শও ঘােষিত হয়েছে। কিন্তু সমাজতন্ত্রের অর্থ সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয় নি। সমাজতন্ত্র প্রকৃতপক্ষে এমন একটি সমাজব্যবস্থা যেখানে উৎপাদনের ওপর সমগ্র সমাজের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং উৎপন্ন সামাজিক মালিকানায় বন্টন করা হয়। ভারতীয় শাসনতন্ত্রে সমাজতন্ত্রের আদর্শ ঘােষিত হলেও জনকল্যাণ রাষ্ট্রের আদর্শই মূল লক্ষ্য হিসাবে গৃহীত। শাসনতন্ত্রের বিভিন্ন অংশে অর্থনৈতিক অধিকার এবং কল্যাণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও ব্যক্তিগত মালিকানা সম্পূর্ণ বিলােপসাধনের কোন সুস্পষ্ট ব্যবস্থা নেই। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে কোন ব্যাখ্যা না থাকায় ভারতীয় সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য কি, সেই বিষয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।
ধর্মনিরপেক্ষতা: শাসনতন্ত্রের প্রস্তাবনায় ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ঘােষিত হয়েছে। ধর্ম নিরপেক্ষতা বলতে বােঝায়, কোন বিশেষ ধর্মের প্রতি রাষ্ট্র পক্ষপাতিত্ব করবে না, ধর্মবিরােধী হবে না বা অধার্মিকতার প্রশ্রয় দেবে না। সকল ধর্মাবলম্বী নাগরিকের সমান সুযােগের ব্যবস্থা এবং ধর্ম সম্পর্কে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা রাষ্ট্রের লক্ষ্য হবে। ভারতীয় শাসনতন্ত্রের প্রস্তাবনায় স্বীকৃত গণতন্ত্রের সামগ্রিক মাপটি আজও ভারতে কার্যকর হয় নি।
সাধারণতন্ত্র: সাধারণতন্ত্র শব্দটির অর্থ হল যে, শাসনব্যবস্থায় রাজা-রানীর স্থান নেই; অর্থাৎ শাসন ক্ষমতা জনসাধারণের ভােটে নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে অর্পিত হয়। ভারতীয় শাসনতন্ত্রে ইংল্যাডের মত বংশানুক্রমিক কোন রাজপদ প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রপতি পরােক্ষভাবে জনসাধারণের ভােটে নির্বাচিত হন। প্রসঙ্গত আর একটি বিষয়ের উল্লেখ করা প্রয়ােজন। ভারত সাধরণতন্ত্র বলে অভিহিত হলেও ব্রিটিশ কমনওয়েলথের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নি। অনেকে এই বিষয়টি ভারতের সাধারণতন্ত্রী রূপের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে করেন। কিন্তু কমনওয়েলথের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সম্পূর্ণ স্বেচ্ছামূলক; প্রয়ােজনবােধে ভারত যে-কোন মূহুর্তে কমনওয়েলথের সদসাপদ ত্যাগ করতে পারে। তাছাড়া কমনওয়েলথের ধারণা প্ররিবর্তিত হয়েছে। কমনওয়েলথের সদস্যভুক্ত হবার জন্য রাজশক্তির নিকট আনুগত্যের প্রয়ােজন নেই। সুতরাং ভারতের কমনওয়েলথের সদস্য হওয়ায় কোনরকম অসঙ্গতি দেখা দেয় নি। শাসনতন্ত্রবিদ বি. এন. রাও (B. N. Rao) বলেছেন যে, কমনওয়েলথের ধারণা ক্রমপরিবর্তিত হয়ে আজ এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, এর মধ্যে সাধারণতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলি সহজেই স্থান পেতে পারে।