ফ্রান্সের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য কি?
Sign Up to our social questions and Answers Engine to ask questions, answer people's questions, and connect with other people.
Login to our social questions & Answers Engine to ask questions answer people's questions & connect with other people.
Sujata Shukla
১৯৫৮ সালের জুন মাসে চতুর্থ সাধারণতন্ত্রের পতন ঘটে। জাতীয় পরিষদ নিজ মৃত্যুপরোয়ানা স্বাক্ষর করে শাসন ক্ষমতা জেনারেল দ্য গলের (De Gaulle) হতে সমর্পণ করে। নতুন সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্বও দ্য গলের ওপর ন্যস্ত হয়। নতুন সংবিধানের খসড়া বিপুল ভােটে ১৯৫৮ সালের ২৮ শে সেপ্টেম্বর গৃহীত হয় এবং ৪ ঠা অক্টোবর কার্যকর হয়। ১৯৫৯ সালের জানুয়ারী মাসে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের সময় দ্য গল ঘোষণা করেন যে ফরাসী জাতীয় জীবনে এবং ফরাসী কমিউনিটির সামগ্রিক স্বার্থের উন্নয়নে এক নতুন গতি সঞ্চারের নিরলস প্রচেষ্টাই হবে তার প্রধান কর্তব্য। এই দায়িত্ব পালনে তিনি সাফল্যের আশা প্রকাশ করেন।
নতুন সংবিধানের বৈশিষ্ট্য আলােচনার মাধ্যমে এর স্বরুপ উপলব্ধি করা যাবে। পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানকে ‘দ্য গলের নিজস্ব পরিমাপে তৈরী’, ‘অর্ধ-রাজতান্ত্রিক’, অর্ধ-রাষ্ট্রপতি পরিচালিত’, ‘ফরাসী শাসনতন্ত্রের ইতিহাসে নিকৃষ্ট খসড়া’, প্রভৃতি নানা বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। অতীত দিনের সংবিধানের তুলনায় পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধান অভিনবত্বের দাবী করতে না পারলেও আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস, শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রধানমন্ত্ৰী ও ক্যাবিনেটের তুলনায় রাষ্ট্রপতির বিশেষ মর্যাদার জন্য পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের পার্থক্য লক্ষ করা যায়। নতুন সংবিধানের মূল পরিকল্পনায় দুটি মৌল বিষয় প্রাধান্য পায়: (১) এক শক্তিশালী শাসন কর্তৃপক্ষের নেতৃত্বে রাষ্ট্রক্ষমতার পুনগঠন, এবং (২) সীমাবদ্ধ রাজনৈতিক ও আইনগত ক্ষমতাসহ এক পার্লামেন্ট গঠন।
ফ্রান্সের পঞ্চম সাধারণতন্ত্র সংবিধানের বৈশিষ্ট্য
(১) প্রস্তাবনা (Preamble) : পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধান একটি প্রস্তাবনা ও ৯২ টি ধারা নিয়ে গঠিত। ধারগুলিকে ১৫ টি শিরােনাম বা অধ্যায়ে বিভক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় ১৭৮৯ সালের মানব অধিকারের ঘােষণার প্রতি এবং জাতীয় সার্বভৌমিকতার মূলনীতির প্রতি শ্রদ্ধার কথা ঘােষণা করা হয়েছে। সমুদ্রপারের বিভিন্ন অঞ্চল ও রাজ্যে গুলির সাম্য, স্বাধীনতা ও মৈত্রীর ভিত্তিতে নতুন সংস্থার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথা প্রস্তাবনায় ঘােষণা করা হয়েছে। ১৯৪৬ সালের চতুর্থ সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের প্রস্তাবনায় মানব অধিকার সম্পর্কিত ঘােষণাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল।
(২) সাধারণতন্ত্রী ঐতিহ্য ও জনগণের সার্বভৌমত্ব : নতুন সংবিধানে ফ্রান্সের সাধারণতন্ত্রী ঐতিহ্য এবং জনগণের সার্বভৌমত্বকে গুরুত্বের সঙ্গে স্বীকার করা হয়েছে। ঘােষণা করা হয়েছে যে ফ্রান্স হবে একটি অবিভাজ্য, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সামাজিক সাধারণতন্ত্র। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের সুযােগ সংবিধানে স্বীকার করা হয়েছে। নীল, সাদা ও লাল এই তিনরঙা পতাকা হবে জাতীয় পতাকা এবং ‘মার্সাই’ (Marseillaise) হবে জাতীয় সঙ্গীত। এই বিপ্লবী সঙ্গীত ১৭৯২ সালে ডি. লিসল (Rought de Lisle) রচনা করেন এবং ৩০ শে জুলাই প্যারীতে প্রবেশের সময় মার্সাই এর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এই গান গেয়েছিলেন। নতুন সাধারণতন্ত্রের মূলমন্ত্র হল ‘সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা’। এই সরকার হবে জনগণের দ্বারা জনগণের কলাণার্থে জনগণের শাসন। সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে ঘােষিত হয়েছে যে, জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। জনগণ তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এই সার্বভৈীম ক্ষমতা কার্যকর করবে।
(৩) রাজনৈতিক দল : পঞ্চম সাধারণতন্ত্রে সংবিধানে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধানে রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি অভিনব বিষয় বলা যায়। চীন ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোন উদারনৈতিক গণতন্তে সংবিধানের মধ্যে রাজনৈতিক দলের উল্লেখ থাকে না। পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বই শুধু স্বীকার করা হয় নি, রাজনৈতিক জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবে রাজনৈতিক দলকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলিকে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের মৌল নীতি মান্য করে কাজ করতে হবে বলা হয়েছে। সংবিধানে রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতির ফলে একদলীয় শাসনব্যবস্থা সংবিধান বিরােধী বলে গণ্য হবে। অনেকে অভিমত পােষণ করেন যে, কমিউনিষ্ট দলের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে তাদের প্রতি লক্ষ্য রেখেই সংবিধানে এই অংশটি উল্লেখ করা হয়েছে।
(৪) এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা : “পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানে ইংল্যাণ্ডের মত ফ্রান্সে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে” সমগ্র ফ্রান্স কতকগুলি বিভাগ বা ডিপার্টমেন্ট -এ বিভক্ত করা হয়েছে। ডিপার্টমেন্টগুলি আবার ক্যান্টনে বিভক্ত। প্রতি ক্যান্টন কতকগুলি Arrondisement -এ বিভক্ত এবং প্রতি অ্যারনডাইসমেন্ট কতকগুলি Corumune বিভক্ত। স্বায়ত্তশাসনের জন্য প্রতি স্তরে স্থানীয় শাসন কর্তৃপক্ষ থাকলেও তাদের নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই। পার্লামেন্ট স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনমুলক সংস্থাগুলির ক্ষমতা ও এলাকা নির্ধারণ করে দেয়।
(৫) পার্লামেন্টীয় ও রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারের সমন্বয় : পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধান দুটি সম্পূর্ণ ভিন্নতর ধারণার — পার্লামেন্টীয় ও রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার — মধ্যে সময় সাধনের চেষ্টা করেছে। চতুর্থ সাধারণতন্ত্রের ব্যর্থতার জন্যে নতুন সংবিধানে শাসন বিভাগকে শক্তিশালী করে গঠন করার ব্যবস্থা হয়েছে। সাধারণ অবস্থায় রাষ্ট্রপতির ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন হলেও সংকটের দিনে রাষ্ট্রপতির ভূমিকাই কার্যকর হবে। দ্য গল মার্কিন রাষ্ট্রপতির ভূমিকার অনুকরণে ফরাসী রাষ্ট্রপতিকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নতুন সংবিধানে সম্পূর্ণ মার্কিনী ধাঁচের রাষ্ট্রপতি পদ প্রবর্তিত হয়নি। তা সত্ত্বেও সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় রাষ্ট্রপতির ব্যাপক ক্ষমতার প্রকাশ হয়। সুতরাং সংবিধানে একদিকে সংসদীয় বা ক্যাবিনেট ব্যবস্থার নীতিগুলি স্বীকার করা হয়েছে, অপরদিকে শক্তিশালী রাষ্ট্রপতি পদের ভূমিকাও স্বীকৃত হয়েছে। সংসদীয় ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রপতির প্রকৃত নেতৃত্বের সহাবস্থান শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে সার্থক হয়েছে কি না, তা ভবিষ্যত ফরাসী রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থায় প্রমাণিত হয়েছে।
(৬) সীমাবদ্ধ পার্লামেন্টীয় ব্যবস্থা : নতুন সংবিধানে এক যুক্তিসিদ্ধ পার্লামেন্ট সীমাবদ্ধ ক্ষমতাসহ প্রবর্তিত হয়েছে। সরকারকে জাতীয় সভার (National Assembly) কাছে দায়ী থাকতে হয়। জাতীয় সভার সংখ্যাগরিষ্ঠের ভােট অনাস্থা প্রস্তাব গৃহীত হলে মন্ত্রিপরিষদকে পদত্যাগ করতে হয়।
(৭) অসামঞ্জস্যর নীতি: পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের এক অভিনব বৈশিষ্ট্য হল পার্লামেন্ট সদস্যপদ এবং ক্যাবিনেট সদস্যপদ লাভের মধ্যে অসামঞ্জস্যর নীতি (principle of incompatibility) অনুসরণ। অর্থাৎ একই ব্যক্তি পার্লামেন্ট ও ক্যাবিনেট সদস্য হতে পারবেন না। সুতরাং ফ্রান্সে ক্যাবিনেট শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হলেও ক্যাবিনেট শাসনব্যবস্থার মূলনীতি অস্বীকার করা হয়েছে। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রধান প্রবক্তা মন্তেস্কুর নিজের দেশ ফ্রান্সে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এখানে মার্কিন সংবিধানের মত শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের বিভাজন স্বীকার করা হয়েছে।
(৮) আইনসভার ক্ষমতা হ্রাস: পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানে আইনসভার ক্ষমতাকে বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। চতুর্থ সাধারণতন্ত্রের আমলে আইনসভার আচার, আচরণ এবং বিভিন্ন ক্ষমতা সঙ্কুচিত করা হয়। পার্লামেন্টের অধিবেশনের সময়কাল হ্রাস করা হয়। চতুর্থ সাধারণতন্ত্রে আইনসভার অন্তত ৭ মাস অধিবেশন হতাে। নতুন সংবিধানে বছরে ২ বার করে মােট ৫ মাস ২০ দিন অধিবেশনের ব্যবস্থা হয়েছে। পার্লামেন্টের কাজ পরিচালনার নিয়মাবলী, স্থায়ী নির্দেশ (standing orders) জারি প্রভৃতি বিষয়েও জাতীয় সভা ও সিনেটের ক্ষমতা সঙ্কুচিত করা হয়েছে।
(৯) দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা: পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানে আইনসভাকে দ্বিকক্ষ-সমন্বিত করা হয়েছে। নতুন সংবিধানে দ্বিতীয় কক্ষ সিনেট (Senate) -এর ক্ষমতা পুর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি করা হয়েছে। সিনেট সভার কার্যাবলী সম্প্রসারিত করে এবং অন্যান্যভাবে এর মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়েছে। সিনেট জাতীয় সভার সঙ্গে সমান ক্ষমতা ভােগ করে। আইন প্রণয়নে জাতীয় সভার পক্ষে সিনেটকে উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী ও সরকার ইচ্ছা প্রকাশ করলে সিনেট আইন প্রণয়নে ভিটো (Veto) প্রয়ােগ করতে পারে। সংবিধানের ৪৫ নং ধারায় বলা হয়েছে যে, আইনসভার উভয় কক্ষের মত বিরােধে প্রধানমন্ত্রী উভয় কক্ষের সদস্যদের নিয়ে যৌথ কনফারেন্স আহ্বান করতে পারেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যৌথ অধিবেশন আহ্বান করতে না চাইলে বিলের সমাধি রচিত হয়।
(১০) গণভােট: পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের আর একটি গুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হ’ল গণভোট ব্যবস্থা (referendum)। শাসনতান্ত্রিক আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, সাধারণ আইন প্রণয়নের বিষয়েও গণভােট ব্যবস্থা স্বীকার করা হয়েছে। সরকারের প্রস্তাব অনুসারে অথবা আইনসভার উভয় কক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাধারণ স্বার্থ সম্পর্কিত যে কোন বিষয় রাষ্ট্রপতি গণভােটে পাঠাতে পারেন। গণভােট ব্যবস্থা জাতীয় পরিষদের ক্ষমতাকে সঙ্কুচিত করেছে। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে গণভােটের মূল্য স্বীকৃত হলেও ইহা পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত সংসদীয় গণতন্ত্রের ঐতিহাের বিরােধী। গণভােটের সুযােগ গ্রহণ করে দ্য গল পার্লামেন্টকে উপেক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
(১১) রাষ্ট্রপতির জরুরী অবস্থা ঘােষণার ক্ষমতা: পঞ্চম সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের ১৬ ধারায় রাষ্ট্রপতিকে জরুরী অবস্থা ঘােষণার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে (” The President possesses an emergency Power of exercising a constitutional dictatorship.” — S.E. Finer)। অতীতে সাংবিধানিক ব্যবস্থায় জাতীয় জীবনের সংকট সময়ে কোন বিশেষ ক্ষমতা সরকারের ওপর অর্পণ করা হয় নি। নতুন সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ওপর জাতীয় স্বাধীনতা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সংকটজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হলে জরুরী অবস্থা ঘােষণার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী জরুরী অবস্থা ঘােষণার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রী, আইনসভার উভয় কক্ষের সভাপতি এবং শাসনতান্ত্রিক পরিষদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হয়। কিন্তু এইসব ব্যক্তি বা সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করার বিষয়ে কোন বাধ্যতামূলক শর্ত আরােপ করা হয়নি।